বৈশাখের রোদেলা সকাল। নীলাকাশ , আকাশে সাদা মেঘ উড়ছে সীমানা ছাড়িয়ে। আলমের মন কিছুটা খারাপ । সেই ছোতকাল থেকে ঢাকা শহরে বেড়ে উঠা । গ্রাম দেখা হয়নি কখন ও । সেই তাকেই কিনা এখন চাকুরী করতে ঢাকা যেতে হবে । সরকারের নির্দেশ কমপক্ষে গ্রামে ডাক্তারী করতে হবে দুই বছর। অনেক ভেবে চিনতে পরিশেষে গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ।
নিজের প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিল আলম। আলমের বাবা মারা গেছেন চার বছর পূর্বে । ঢাকায় গোরানে নিজেদের বাড়ি আছে । তার বাবা ঢাকা ওয়াসায় চাকুরী করত । বাড়িতি সেই সময়ের কেনা । সম্পদ বলতে গেলে তার বাবা শুধুমাত্র বাড়িটিই রেখে গেছেন । টিনশেড আধা পাকা বাড়ি । দুই রুম ছাড়া বাকী দুই রুম ভাড়া দিয়েছেন তার মা বুহুদিন আগে । সেই ভাড়াটিয়ারা আজো আছে । নিজেদের আপন মানুষের মত হয়ে গেছে । বেশ কয়েকটি ডেভেলপার কোম্পানী বাড়িটি নিতে ছেয়েছে কিন্তু তার মা রাজী হয়নি । আলমের মায়ের স্বপ্ন তার ছেলে চাকুরী করে নিজের পছন্দ মত বাড়ি বানাবে । আলম নিজে ও এই ব্যাপারে কিছু ভাবে না । ছোট কাল থেকেই নির্লোভ আলোম গড়ে উঠেছে মায়ের ভালোবাসা এবং আদর্শে। লেখাপড়ায় বরাবর বেশ ভালো । সবাই বলে সে নাকি তার বাবার মতই মেধাবী।
ছেলে গ্রামে যাচ্ছে দেখে মায়ের কাছে খারাপ লাগছে । কিন্তু তিনি সেটা বুঝতে দিচ্ছেন না । ছেলের কি কি জিনিস দরকার তা তিনি ব্যাগে গুছিয়ে দিচ্ছেন পরম মমতায়। কিভাবে চলতে হবে , কখন ঘুমাতে হবে আর কত কি করতে হবে এসব নিয়ে বেশ দীর্ঘ একটা উপদেশ দিলেন। আলম মনযোগী ছাত্রের মত প্রতিটি কথা শুনল । মায়ের পায়ে ধরে সালাম করে বুকের সাথে মাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মত কেঁদে উঠল আলম। তার মা তাকে শান্তনা দিলেন । বলে উঠলেন ‘কাদার কি দরকার আছে সাপ্তায় আসবি , ব্যাস এই কয়দিন’ ।
বাসা থেকে বেরিয়ে সায়েদাবাদ ষ্টেশন থেকে বাসে করে রওনা দিল আলম । বাসে বসে থাকতেই হুট করে আকাশ মেঘলা হয়ে এল , নীলাকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল নিমিষেই। সবাই বলল কালবৈশাখী ঝড় হবে । গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে আলম তখন দৈনিক পত্রিকা পড়ায় মগ্ন। ঘন্টা দুয়েক পর বাস থামল মুদাফপরগঞ্জ বাজারে । প্রবল জোড়ে বাতাস বইছে । যাত্রী চাউনিটা যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে এমন মনে হল । বেশ দূরের মাঠ ঘর বাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছে না আঁধার যেন বেড়েই চলছে । একটি রিক্সার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই । দৈবক্রমে সেখান দিয়ে এক ঠেলা ওয়ালা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিল। আলম ঠেলা ওয়ালাকে ডেকে তাকে বাদুরতলা গ্রামে নামিয়ে দিতে বলল। ঠেলা ওয়ালা আলমের দুরাবস্থা বুঝে তাকে ঠেলাতে তুলে নিল । একটি প্লাস্টিকের পলিথিন দিয়ে আলম নিজেকে মুড়ে ঠেলায় বসে পড়ল । কাঁচারাস্তা ঠেলা ওয়ালা নেমে হাত দিয়ে টেনে ঠেলা নিয়ে চলতে লাগল ঝড়, বাতাস , উপেক্ষা করে । রাস্তা এখন পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে । সামনে পেছনে কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না । পলিথিন কোন কাজ দিল না , বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে আলম । ঠেলা ওয়ালা নির্বিকার তার এসবে অভ্যাস আছে । কিন্তু আলমের অভ্যাস নেই । কিছুদুর যেতেই ঠেলা রাস্তার কাদায় আটকে গেল।। অনেক তানাটানি করে ও লাভ হচ্ছে না । এই সময় ঠেলা ওয়ালা বলে উঠল ‘ভাইসাব আপনে পাশের স্কুল ঘরে গিয়ে দাড়ান । আমি ঠেলা তুলে নিয়ে আসছি’
‘ঠিক আছে’ বলে আলম ঠেলা ওয়ালার দেখানো স্কুল ঘরের দিকে গেল ।
স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে নিজের চাকুরী কে মনে মনে গাল দিতে লাগল । আবার ভাবল দেশের বেশীর ভাগ মানুষই এই ঝড় বাদল , কালবৈশাখী কে সঙ্গে করে বেঁচে থাকে । শহুরে বলে সে কেন দূরে থাকবে । বাতাসের ঝাপটায় স্কুলের বারান্দায় দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না । তাই দেখতে লাগল কোন দরজা খোলা আছে কিনা । সামনের রুমের একটি দরজা বাতাসের ঝাপটায় নড়ছে এদিকে সেদিকে । তাই দেখে এগিয়ে এল আলম । রুমের ভেতর ঢুকে নিজের ব্যাগ রাখল মেঝেতে । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হঠাৎ বিদ্যুতের আলোর ঝলকে যা দেখল তাতে ভয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল আলম ।
তার ঠিক দুইহাত সামনে একটি চেয়ারে বসে আছে কে যেন । মুখ দেখা যাচ্ছে না । মাথা নিচু করে রাখার কারনে।লম্বা কালো চুল প্রায় মাটি ছুঁয়ে আছে ।আধারের কারনে এর চেয়ে বেশী নজরে এল না । ভুত প্রেতে একজন ডাক্তারের তেমন বিশ্বাস থাকে না , আলমের ও নেই । তারপর ও এই ভয়াল সন্ধ্যায় একজন মানবী নিঃশব্দে তার সামনে নির্জন স্কুল ঘরের মাঝে বসে আছে , সেটা দেখে কার না ভয় হবে । অনেক সাহস করে আলম আবার চোখ মেলে তাকালো । তার উপস্থিতি টের পায়নি এখনো ভুত কিংবা মানবী। সাহস করে হাত বাড়াতে গিয়ে ও থমকে দাড়াল । আবার বিজলী চমকাল। এবার স্পষ্ট দেখতে পেল । হা । একটা মেয়ে মানুষ বসে আছে স্থির হয়ে। সাহস করে বেশ জোরে বলে উঠল আলম ‘কে ওখানে , কথা বলুন প্লিজ’।
হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে এই ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করল মেয়েটি। মেয়েটির রক্তিম চোখ আর তার নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া অশ্রু ধারা দেখে আলম ভয় পেয়ে গেল আরো বেশী। আবার বিজলী চমকাল এবার স্পষ্ট মেয়েটির মুখ দেখতে পেল আলম । এত সুন্দর চেহারার মেয়ে মানুষ আগে দেখেছে কিনা সন্দেহ হএ লাগল । তবে সেই সময় মেয়ের রুপে মুগ্ধ হওয়ার চেয়ে ভয়ে কাঁপছে আলমের শরীর। মেয়েটি বেশ সুরেলা গলায় চিকন স্বরে বলে উঠল ‘আগে বলুন আপনি কে’?
‘আমি আলম ঢাকা থেকে এসেছি, বৃষ্টি বাদলে আটকা পড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছি’।
‘আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই , আমি এই গ্রামের চৌধুরী সাহেবের মেঝ মেয়ে,ল্যাংড়া হাটতে পারিনা।এই যে দেখছেন এটা হুইল চেয়ার’।বলে থামল মেয়েটি।
আলম তাকিয়ে দেখল সত্যি মেয়েটি হুইল চেয়ারে বসে আছে । এত সুন্দর একটি মেয়ে এখানে হুইল চেয়ারে কেন বসে আছে তা বুঝতে পারছে না আলম ।
আমাকে এখানে দেখে অবাক হচ্ছেন তাই না’।
‘অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক’।
‘আপনি কি কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে একটা খোঁজ দিতে পারবেন।আমার বোন আমাকে প্রতিদিন এখান থেকে নিয়ে যায় । আজ হয়তো ভুলে গেছে’।
‘আপনি এই ঝড়ের দিনে এখানে কি করছেন এটা কি বলা যায়’
‘শুনবেন আমার কথা , বিরক্ত হবেন নাতো!’
‘না , বিরক্ত হব কেন?’
‘এর আগে বলেন আপনি এই ঝড়ের দিনে এখানে কেন এলেন’
‘আমি আগেই বলেছি, কিভাবে এসছি। কিন্তু কেন এসেছি তা এখান বলছি’।
এরপর আলম কি উদ্দেশ্যে আসা তা বিস্তারিত বলতে লাগল এবং মাঝপথে থেমে বলল
‘আমার নাম আলম , কিন্তু আপনার নামটা’
‘আমি শিলা।আমার বাবা এই এলাকার গন্যমান্য লোক। গত বছর কলেজ ছুটির এক বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায় আমি আর আমার বোন কনা ঘরের দরজায় বসে বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। শুকনো শিমের বিচি চিবুচ্ছি এং নানা বিষয়ে কথা বলছিলাম। কি একতা বিষয় নিয়ে দুই জনে বেশ হাসাহাসি করছিলাম। হুট করে আমার ছোট বোনের সাথে সামান্য ধাক্কায় আমি সিড়ির পিচ্ছিল শ্যাওলায় পিচলিয়ে পড়ে যাই নিচে। পড়ার সময় পা বেকায়দায় পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। আমি চিৎকার করে উঠে দাড়াতে চেষ্টা করি উঠে দাড়াতে কিন্তু সেই থেকে আর দুই পায়ে দাড়াতে পারিনি’।এততুকু বলে থামল শিলা।
‘তারপর’
‘এরপর স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল । সেখানে এক্সরে করে দেখা গেল পায়ের গোড়ালীর উপরের দিকে টিবিয়া ফিবুলা দুইটি হাড় কোনাকুনি ভাবে ভেঙ্গে গেছে । প্রথমে প্লাস্টার করল অনভিজ্ঞ ডাক্তার । সেটাই কাল হল । ভেতরে হাড় জোড়া লাগার পরিবর্তে পচতে শুরু করল ভেতরের মাংস। তিন মাস পর প্লাস্টার খোলার পর এক্সরে করে দেখা গেল হাড় জোড়া লাগেনি । কিন্তু পায়ের মাংসে পচন ধরে গেছে এবং কয়েক জায়গায় ঘা হয়ে গেছে । এরপর ঢাকা পিজি হাসপাতলে নিলে অর্থপেডিক সার্জেন বলল পা কেটে ফেলতে হবে কারন ক্ষতে ইনফেকশন শুরু হয়ে গেছে । এরপর পা কেটে ফেলা হল। আর হুইল চেয়ার আমার সাথী হয়ে গেল’।এই পর্যন্ত বলে শিলা আবার থামল। তার দুইচোখে তখন কষ্টের অশ্রু জল ।
আলম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু চুপ করে রইল বাকীটুকু শুনার জন্য।
‘একা একা হুইল চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে আমি বিরক্ত হয়ে উঠলাম। এক সময় একটি এন জি ও এর এক আপা আসল আমাদের বাড়ি । আমার দুরাবস্থা দেখে তিনি আমাকে সাহস জোগালেন। এরপর আমাকে প্রশিক্ষণ দিলেন এবং আমাকে একটি চাকুরী দিলেন । স্কুলের সময়ের শেষে গ্রামের মহিলাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলাম। আমার বোন প্রতিদিন আমাকে এখানে দিয়ে যায় এবং বিকালে এসে নিয়ে যায় । আজো ছুটির পর আসার কথা কিন্তু এখনো আসে নাই। এই হল আমার ইতিহাস’।
‘চলুন আমার সাথে ভ্যান ওয়ালা আছে আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি’।
না আপনার কষ্ট করার কি দরকার আমাদের বাড়িতে একটা খব্র দিলেই হবে। স্কুলের সামান্য দূরে বামপাশে একটি দোকান আছে। সেখানে গিয়ে চৌধুরী বাড়ি কোনদিকে বললে দেখিয়ে দেবে’।
‘আমি এই অবস্থায় আপনাকে একা রেখে যেতে পারিনা। আমি ভ্যান ওয়ালাকে ডাকছি’।
২
এরপর থেকে আলম নিয়মিত চৌধুরী বাড়িতে আসে যায় । শিলার সাথে তার বেশ ভাল একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে ধীরে ধীরে । গ্রামের সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার হিসাবে আলমের নাম ছড়িয়ে পড়ে । গ্রামের মানুষ গুলো এমনিতেই বেশ সহজ সরল । এদেরকে সঠিক গাইড লাইন দিলে এরা ও বেশ ভাল হয়ে উঠে দ্রুত। বেশীর ভাগ রোগী আসে আলমের কাছে পেটের সমস্যা খোসপাঁচড়া এসব নিয়ে । আলম চিকিৎসার পাশাপাশি এদের কে সচেতন করে । পরিস্কার থাকার জন্য বলে এছাড়া কিভাবে পরিস্কার পরিছন্ন থাকা যায় সে সম্পর্কে বলে। গ্রামের মানুষ তার কথা সাধ্যমত মেনে চলতে চেষ্টা করে । দেখাগেল সচেতনতার কারনে দুই মাসের মধ্যেই রোগীর সংখ্যা অর্ধেক কমে গেছে । খাওয়া দাওয়া নিয়ে তেমন চিন্তা করতে হয়না । গ্রামের লোক আজ এটা সেটা নিয়ে আসে তো কাল আরেকটা । গ্রামের এই সহজ সরল মানুষের সারল্য এবং নির্লোভ আলম কে মুগ্ধ করে তুলছে দিনে দিনে । অন্য দিকে শিলাকে ও তার বেশ ভাল লাগে । সেদিকে ও অন্য একটা সম্পর্কে জরিয়ে যাচ্ছে মনের অজান্তে । মাঝে মাঝে শিলাকে নিয়ে গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে নিয়ে যায় । তখন দুজনের মধ্যে অনেক কথা হয় । তা শুধু দুইজনেই জানে ।
শিলা মনে মনে ভাবে শহরে বসবাস করা এক ডাক্তার কি তাকে ভালোভাসে । আর যদি ভালোবাসে তাতেই বা কি লাভ তাকে তো আর বিয়ে করবে না । শিলা এখন আর আফসোস করে না নিজের জীবন নিয়ে । আলম যেন তার জীবনে এক তুলি । তার ক্যানভাসটা ভরিয়ে তুলেছে সেই তুলির আচড় দিয়ে দিয়ে । সময় পার হয় , দিন শেশে রাত্রি আসে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে শিলা অপেক্ষা করতে থাকে আলমের জন্য । মাঝে মাঝে আলম ঢাকাচলে গেলে খুব খারাপ লাগে । কিন্তু কি করবে ভেবে পায়না । বাসার সকলে এই মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত। চৌধুরী সাহেবের অনেক আছে কিন্তু তাই বলে টাকা দিয়ে তো আর যেখানে সেখানে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যায় না । মেয়ের ও মতামত থাকা দরকার । এই নিয়ে তিনি অনেক সম্পর্ক এনেছেন , মেয়ে তার একটি সম্পর্ক ও পছন্দ করে নি । বলে কিনা বিয়েই করবে না । ডাক্তার আলমকে তার মেয়ের পছন্দ , কিন্তু পছন্দ হলে কি হবে ডাক্তার কি তাকে বিয়ে করবে ?
এবার ঢাকা থেকে ফিরতে আলমের দেরী হয়ে গেল । আলমের মায়ের প্যারালাইজড হয়েছে । দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোনকে এনে মায়ের খেদমত করাচ্ছে। গ্রামের জন্য আলমের এখন অন্য রকম মায়া জন্মে গেছে । বিশেষ করে শিলা’র প্রতি । কিন্তু এই কথা মাকে বলা হয়নি এখনো ।
এই দিকে চৌধুরী সাহেব আর সহ্য করতে পারছেন না । বিদেশ ফেরত এক ছেলের সাথে তিনি মেয়ের বিয়ের কথা পাকা করতে যাচ্ছেন। সেদিন বিকালে আলম ঢাকা থেকে এসে শিলাকে কাঁদতে দেখে কি হয়েছে জিগ্যেস করলে শিলা তার বাবার ইচ্ছার কথা আলম কে জানায় ।
আলম কি করবে বুঝতে পারে না । সে চিন্তিত মুখে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে যায় । কনা নাস্তা নিয়ে এসে দেখে ডাক্তার সাহেব চলে গেছে । সেই ভাবে তার আপু মনে হয় ডাক্তার সাহেবের সাথে ঝগড়া করেছে । কনার বেশ মন খারাপ হয় । কারন তার কারনেই আজ তার আপুর এই দশা । তাই আপুকে কিছু না বলে নিজের রুমে চলে যায় কনা।
রাত আনুমানিক দশটার দিকে রক্তলাল চোখে কিছুটা পাগলাটে ভাবে শিলাদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায় আলম । চৌধুরী সাহেব এত রাতে ডাক্তার কে দেখে ভয় পেয়ে যান । কিন্তু আলম কোন কথা না বলে সরাসরি বলে উঠে
‘শিলা কোথায় ? আঙ্কেল’
কেন বাবা কি হয়েছে । চৌধুরী সাহেব প্রশ্ন করেন ।
আপনি যদি রাজী থাকেন আমি এখনি শিলাকে বিয়ে করতে রাজী আছি । আপনি রাজী থাকলে ব্যাবস্থা করেন । আমার পক্ষ থেকে কেউ আসবে না’।
আলমের বলার ধরনে এমন এক দৃঢ়তা ছিল তা চৌধুরী সাহেব উপেক্ষা করতে পারলেন না । তাই ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন
‘আগে ভেতরে আস। তারপর দেখা যাবে কি হয়?’
এরপর ঘটা করেই বিয়ে হয়ে গেল দুইজনের ।
৩
আলমের মা বেশ খুশী হলেন ছেলে বিয়ে করাতে । কিন্তু তিনি জানতেন না তার ছেলের বউ পঙ্গু। বিয়ের কিছুদিন পর তিনি যখন লোক মারফতে এই খবর পেলেন তখন বেশ কষ্ট পেলেন । আর সেই কারনে তিনি শিলাকে নিজের বাড়িতে তুলে নিলেন না । আলম মাকে না জানিয়ে বিয়ে করায় নিজে ও মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন । কিন্তু আলমের ধারনা ছিল মা শেষ পর্যন্ত মেনে নিবেন। কিন্তু তার মা যে এমন রাগ করবেন তা তার জানা ছিল না।
শিলার শুধু একটা পা নেই । এছাড়া আর সবই ভাল । শিলা খুব ভাল রান্না করতে পারে । এছাড়া সংসারের বেশীর ভাগ কাজ শিলা কষ্ট করে হলে ও নিজ হাতে করে । শুধু একটি পা নেই বলে কি সমাজ এবং সমাজের মানুষ তাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখবে , এটা ভাবতে খারাপ লাগে আলমের । আর সেই কারনেই সকলের সিদ্ধান্ত কে উপেক্ষা করে নিজের সিদ্ধান্তে শিলাকে বিয়ে করেছে । অনেকে তাকে বোকা বলে তাতে তার কিছুই যায় আসে না । সে শুধু নিজে জানে সে কি পেয়েছে ।
স্বামীর প্রতি শিলার ভালবাসা খুব তীব্র । চেষ্টা করে তার যেন কোন্রকম সমস্যা না হয় । শিলা এমনিতেই রুপবতী । আলম তাকে যেমন গভীর ভাবে ভালবাসে , সেও তেমনি করে সেই ভালবাসার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করে। ভালাবাসায় মাখামাখি দুইজনকে দেখলে অন্য যে কোন দম্পতির হিংসা হতেই পারে । সুখের সাতকাহনে তাদের দিন গুলো বেশ কাটছিল । আলম সারাদিন হাসপাতালে থাকে । শিলা হাসপাতালের পেছনে কোয়াটারে তখন আলমের পছন্দের খাবার বানাতে বানাতে সময় পার করে ।
আজ সকাল থেকেই শিলার শরীর তেমন ভালো না । সকাল এগারটার দিকে একবার বাথরুমে বমি করেছে । তা দেখে বাসার কাজের মেয়ে ছুটে আলমকে খবর দিল । আলম তাড়াতাড়ি এসে শিলাকে চেকাপ করে দেখল। এরপর বেশ গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে পড়ল ।
আলমকে গম্ভীর হতে দেখে শিলা বেশ ঘাবড়ে গেল । বলল
‘কি হয়েছে , কঠিন কিছু না তো’
হুম একেবারে কঠিন তা নয় , আবার কঠিন ও’।
‘কি কঠিন , বলো না’।
আলম এবার হাসতে হাসতে বলে উঠল নতুন অতিথি আসছে শিলা।
‘কি? সত্যি বলছ!।খুশিতে শিলার চোখে মুখে আলোর ঝলক দেখা গেল ।
ঢাকায় আলমের মায়ের কাছে এই খবর চলে গেল । সব অভিমান ভুলে তিনি আলমকে ডেকে পাঠালেন । আলম যখন ঢাকায় গেল তখন তার মা বৌকে ঢাকায় আনার জন্য বললেন ।
কিছুদিন পর আলম হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে শিলাকে নিয়ে গেলেন ।
আট মাস পর
একদিন সকালে শিলা হুইল চেয়ারে বসে সিড়ির কাছে রুমালে ফুল তুলছিল মনের আনন্দে । সামনে যাবার জন্য , সামনে না তাকিয়ে হুইল চেয়ারের হুইল ঘুরাল হাত দিয়ে । হঠাৎ করে সামনে তাকিয়ে দেখে হুইল চেয়ার এগিয়ে চলছে সিঁড়ির দিকে । শত চেষ্টা করে ও থামাতে পারলো না হুইল চেয়ারের গতিকে। সিঁড়ির চার ধাপ পেরিয়ে উল্টে পড়ল হুইল চেয়ার শিলাকে নিয়ে। ঘরের ভেতর থেকে আরেক হুইল চেয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে আলমের মা । শিলাকে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করতে লাগলেন ।
হাসপাতালে নেওয়ার পর শিলাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। অপারেশন থিয়েটারের সামনে উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করছে আলম, হুইল চেয়ারে বসে আছে তার মা এবং খালাতো বোন । এমন সময় থিয়েটারের ভেতর থেকে নবজাতকের আগমন বার্তা ভেসে এল । নতুনের আগমনে সবার মুখে হাসি দেখা দিল। কিন্তু অপারেশন থিয়াটারের ভেতর নতুন কে জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যের সাথে পাঞ্জা লড়ছে শিলা।
বিঃদ্রঃআমার কাছে জন্মের চেয়ে আর কোন কিছুকেই নতুন বলে মনে হয়না । আর তাই এই জন্ম নিয়েই মুলত এই গল্পটি লেখা। ভালোবাসা এবং সমাজের একশ্রেণীর (পঙ্গুত্ব )মানুষের জীবনধারা নিয়ে আমার এই লেখা ।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪